কালীপুজোয় চেতলাই কলকাতার বারাসাত

দুর্গাপুজোর পর স্বাভাবিকভাবেই অবসাদের জেটল্যাগে গুটিয়ে যায় বাঙালি। যদিও তার মধ্যে লক্ষ্মীপুজোর ঘরোয়া আবহ এবং বিজয়ার জংশনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরে। আরও বেশি করে বললে ভায়া বিজয়া আমরা এগিয়ে চলি শক্তির আরাধ্য কালীপুজোর দিকে।

আলোর সমাগমে ঝলমলে হয়ে ওঠে আমাদের মন, প্রাণ, আত্মা। দীপাবলির প্রজ্বলনে পুজো পরবর্তী বিষণ্ণতা তো কাটেই। পাশাপাশি দীপান্বিতার পুজোয় অলক্ষ্মীকেও ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা হয়। বলাবাহুল্য, এই অলক্ষ্মী বিদেয় হল গ্লানি এবং নেতিবাচকতার দারিদ্র থেকে মুক্তিলাভ।

বহুদিন আগে শৈশবে কোনও এক ভদ্রলোকের রিকশার পিছনে লেখা দেখেছিলাম, ‘মা কি তোর একার?’ ছোটবয়সে অত বুঝিনি। তবে শিশু মনে এটা বেশ দাগ কেটেছিল, মা তো শুধুই আমার।
ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি, মায়ের এত্ত রূপ! তাই তিনি সবার। ছোটবেলায় শিশুদের মুখে মাতৃদুগ্ধের মতো মা শব্দটি যখন আধো উচ্চারিত হয় তখনই সেই মাতৃশক্তির সঙ্গে জুড়ে যাই আমরা। অধুনা প্যান-আধার লিঙ্কের মতো মা এবং সন্তান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে। মা কালী তো সেই শক্তির প্রতিভূ। যার একাধারে সন্তানের অপত্য স্নেহ বিরাজমান আবার অন্যদিকে সন্তানসন্ততির দিকে যে বা যারা হাত বাড়ায়, দুষ্কর্ম করতে উদ্যত হয় তাদের সমুচিত শিক্ষা দিতে মা প্রলয়ঙ্করী হয়ে ওঠেন। যুগ যুগ ধরে দশমহাবিদ্যার বকলমে আমরা মায়ের এরকম নানা মূর্তি দেখেছি। কোথাও মা মাতৃময়ী স্নেহমমতায় ভরপুর। অপরদিকে অসুর বিনাশিনী মায়ের রণচণ্ডী মূর্তিও শোভিত হয়। সেখানে রক্তচামুণ্ডা থেকে ছিন্নমস্তার মতো ভয়ঙ্কর রূপে মা’য়ের উপস্থিতি। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের সমাহার। মা কালীর বৈচিত্র আস্বাদন করতে হলে বারাসত, নৈহাটি যেতেই পারেন।
যদিও কলকাতার বহু মানুষ কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান চেতলার কালীপুজো দেখে। বুড়ি ছোঁয়াটা অবশ্য শতাব্দীপ্রাচীন কেওড়াতলা মহাশ্মশান কালী দেখে।
এবার আবার সার্ধশতবর্ষে পদার্পণ করল শ্মশানকালী পুজো। সেদিক থেকে গুরুত্ব তো আছেই, তার সঙ্গে মহিমা মিলেমিশে একাকার। কাঠের চিতায় একাধারে যখন শবদেহ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তার পাশে মায়ের মূর্তি অসম্ভব জীবন্ত। মা যেন সন্তানের যাবতীয় পাপ-তাপ ধারণ করে অগ্নিধাত্রী হয়ে উঠেছেন। কথিত আছে, স্বপ্নাদেশ পেয়ে শ্মশানে মায়ের পুজো শুরু হয়। বংশপরম্পরায় সেই ধারা অব্যাহত আছে। বাম জমানায় যখন শ্মশান স্বপন এবং শ্রীধরের তাণ্ডবলীলা চলত তখনও যেমন মায়ের আরাধনা হয়েছে এখন মা-মাটি-মানুষের আমলে কলকাতা পুরসভার অগ্রণী ভূমিকায় কেওড়াতলা মহাশ্মশান তিরোধানের মধ্যেও আক্ষরিক অর্থেই নান্দনিক শিল্পকলা তথা পরিষেবার পরিচর্যায় শ্মশানবন্ধু হয়ে উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে এক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন, দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ তথা ওই ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের পুরপ্রতিনিধি মালা রায়ের অবদান অনস্বীকার্য।

কেওড়াতলায় মায়ের পুজোর কথা দিয়ে চিচিংফাঁকে চেতলায় যাওয়ার আগে লেক সংলগ্ন লেক কালীবাড়ি এবং ট্রাঙ্গুলার পার্কের ডাকাত কালী ছুঁয়ে না গেলে মা নিশ্চিতভাবে পাপ দেবেন। লেক কালীবাড়িতে মূল মূর্তির পাশাপাশি দশমহাবিদ্যার নানা রূপ বিদ্যমান। নতুন ভবনটি নির্মীয়মাণ! আর ডাকাত কালীবাড়ি সম্পর্কে কথিত আছে, গোবিন্দপুর যুগে ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে বলিপ্রদত্ত করা ছিল বাধ্যতামূলক।
এবার আসি বহু প্রতীক্ষিত চেতলায়। দুর্গাপুর ব্রিজ পেরোলেই পেয়ে যাচ্ছি চামুণ্ডা মায়ের মূর্তি। আরাধনা সমিতির পরিচালনায় একটা সময়ে এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা ছিল চেতলা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের কুখ্যাত মস্তানরা। এখানেই কিন্তু কালীপুজোর আরও এক অভিনব দিক খুলে যাচ্ছে। শক্তির প্রতিভূ মা কালী এবং তাঁর নানা রূপ। সেইজন্য জ্যোতিষ মতেও যে গ্রহকে সাহস এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয় সেই মঙ্গল গ্রহের সঙ্গেও মস্তান এবং পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর অভূতপূর্ব যোগ রয়েছে। সাহস ছাড়া ডাকাতি-মস্তানিও হয় না আবার পুলিশ বা আর্মির পক্ষে শত্রুর মোকাবিলা অসাধ্য। চামুণ্ডা থেকে সোজা ফার্স্ট ফরওয়ার্ড করে চলে আসি অপরপ্রান্ত তথা বিখ্যাত চেতলা হাটের এক পাশের মিলন সংঘ ক্লাবের রক্তচামুণ্ডার আরাধনায়। তার সঙ্গে অতি অবশ্যই ছুঁয়ে যেতে হবে চেতলার অতি প্রাচীন এক ইতিহাসকে। যে ইতিহাসের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের আদর্শ। নেতাজি যেমন কালীভক্ত ছিলেন, তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মিলন সংঘের পড়শি পুজো হিন্দ সংঘ ক্লাবের।
প্রয়াত অরুণভূষণ গুহর অগ্রণী ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দ সংঘের ব্যাটন পরবর্তীতে চলে যায় তাঁর সুযোগ্য সহোদর বঙ্গবীর, মিস্টার ইন্ডিয়া প্রভৃতি সম্মাননায় ভূষিত ব্যায়ামবীর স্বর্গীয় তরুণভূষণ গুহর হাতে।
প্রসঙ্গত, তরুণবাবুর অদম্য চেষ্টায় ঠাকুরপুকুরের সামালি অঞ্চলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছে সারমেয় সমাধি ভূমি। কলকাতা তথা দেশের ইতিহাসে ডগ বারিয়াল গ্রাউন্ডের অভিনবত্বে নিঃসন্দেহে নিখিলবঙ্গ কল্যাণ সমিতি এক উল্লেখযোগ্য নাম।
বস্তুত, কালীপুজোর সঙ্গে ব্যায়ামগার তথা শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটেছে এভাবেও।
জাম্প কাটে এবার চলে যেতে হচ্ছে চেতলার অপর অংশে ২৪ পল্লির দশমহাবিদ্যায়। কালী, তারা, ধুমাবতী, ছিন্নমস্তা, কমলা, বগলা, মাতঙ্গীরা এখানে জোট বেঁধে গড়ে তুলেছেন মহাশক্তির মাহাত্ম্য। চেতলায় এসে দশমহাবিদ্যা মিস করলে চলবে না।
ঘুরেফিরে পরিশ্রান্ত হলে একটু-আধটু ডাবের জল বা ফলের রস খেয়ে (সিজন চেঞ্জের সময়ে কোল্ড ড্রিঙ্ক একদম নয়) জিরিয়ে ঝরঝরে হয়ে চলে যেতে হবে ৮৬ পল্লির ছিন্নমস্তায়। যেসব মানুষ নানা দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত, মামলা-মোকদ্দমা থেকে অপঘাত ইত্যাদির ভয়ে অবসাদগ্রস্ত তাঁদের জন্য জ্যোতিষ মতে রাহুর আরাধ্য ছিন্নমস্তার পুজো দেখা আবশ্যিক। অবশ্যই নানা নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে তবেই। কারণ, ছিন্নমস্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হারাকিরির শামিল। চেতলা হল কালীপুজোর কোলাজ। গোবিন্দ আড্ডি রোডে মন্ত্রী ববি হাকিমের ক্লাব অগ্রণী, রাখাল দাস আড্ডি রোডের হাজার হাত কালী, শ্বেত কালী, মা ষোড়শী, রাজবল্লভী, সব্জিবাগানের দশমুণ্ড কালী, আদ্যা কালী, ভবতারিণী, দক্ষিণাকালী, কিরীটেশ্বরী থেকে মায়ের সবরকম মূর্তি চেতলার নানা প্রান্তে পূজিত হন।

বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে চেন দিয়ে বাঁধা ডাকাত কালীর কথা। কথিত আছে, এক ভয়ানক ডাকাতের হাতে প্রতিষ্ঠিত এখানকার মা। তাঁকে চেন দিয়ে বাঁধার মধ্যে ভক্তির বন্ধন ফুটে ওঠে।
গীতাঞ্জলি স্পোর্টিং ক্লাবের চন্দ্রঘণ্টা কালীপুজোও অত্যন্ত জনপ্রিয় চেতলায়। শেয়ার বাজারে মুহুরত ট্রেডিং শুরু এবং শেষের সময়ে যেমন ঘণ্টা বাজানোর প্রথা রয়েছে চন্দ্রঘণ্টাও একইভাবে পুজোর বোধন এবং বিসর্জনের ঘণ্টাধ্বনি করে।
পরিশেষে বলতে হয় মা গঙ্গাকে ভগীরথ যখন এই ধরাধামে নিয়ে আসেন তখন মা দক্ষিণাকালীর আশীর্বাদধন্য এই অঞ্চলেও সেই চিহ্ন পড়েছিল। স্থানীয় এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের বাইরেও চেতলা সন্নিহিত গঙ্গায় একসময় চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য করতে আসতেন বলে মনসামঙ্গল কাব্যে বর্ণিত আছে। তাই কলকাতার কালীপুজো মানে চেতলা মাস্ট।

Post a Comment

Previous Post Next Post